ইসলাম ধর্ম গ্রহন:

হযরত (সঃ) এর নবুওয়াতের প্রথম পর্যায়ে উমার (রাঃ) ছিলেন ঘোর ইসলাম বিরোধী । মক্কার নবদীক্ষিত মুসলিমদের উপর তিনি নির্যাতন চালাইতেন । তিনি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করিতেছিলেন বটে, কিন্তু পরোক্ষে ইসলামের প্রভাবে তাহার শুভবুদ্ধি ক্রমশ জাগরিত হইতেছিল । রাসূল (সঃ) এর অজ্ঞাতসারে একদা তাহার মুখে কুরানের আবৃত্তি শুনিয়া তাহার মনে ভাবান্তর ঘটার বর্ননা পাওয়া যায় । একদিন ভগিনী ও ভগ্নীপতিকে ইসলামে গ্রহণের জন্য নির্দয়ভাবে শাসন করিতে গিয়া নিজেই তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়েন এবং রাসূল (সঃ) এর নিকট উপস্থিত হইয়া ইসলাম গ্রহণ করেন । ইসলাম গ্রহণের ফলে তাহার জীবনের আমূল পরিবর্তন হয় । পরবর্তীকালে তিনি ইসলামের সেবার অক্ষয় কীর্তি রাখিয়া যান ।

খিলাফত লাভের পূর্বে খেদমত:

হিজরতের চার বৎসর পূর্বে যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাহার বয়স ছিল ছাব্বিশ বৎসর।তাহার পর হইতে তিনি পূর্ন শক্তিতে ইসলামের খিদমতে ঝাপাইয়া পড়েন । তাহার গোত্র বানু আদি ইবন্‌ কা’ব হইতে এই ব্যাপারে তিনি কোন সাহায্য পান নাই । মদিনায় তাহার ব্যক্তিগত উদ্যম এবং মনোবলের প্রভাবেই তিনি রাসূল (সঃ) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে মর্যাদা লাভ করেন, গোত্রীয় মর্যাদারকারণে নয় । সৈনিক হিসাবেও তাহার প্রভূত খ্যাতি ছিল । তিনি বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদান করেন । হাদিছে আছে যে, কুরআনের কয়েকটি স্থানে উমার (রাঃ) এর উক্তি সমর্থনে অয়ায়হি অবতীর্ন হইয়াছিল । যথাঃ ২:১২৫- কাবা গৃহের পার্শস্থ মাকাম ইব্রাহীমে সালাত আদায়; ৩৩:৫৩, রাসূল (সঃ) বিবিগণের সামনে পর্দা পালন ইত্যাদি । সাহাবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ) এর অগ্রগণ্য ছিলেন । হযরত উমার (রাঃ) বিনয় সহকারে তাহা স্বীকার করিতেন এবং সর্বদা হযরত আবু বকর (রাঃ) কে যথোপযুক্ত সম্মান দেখাইতেন । তাহাদের কন্যাগণ রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র বিবি তথা উম্মতের জননী হইবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন । রাসূল কারীম (সঃ) এর বিবি হযতর হাফসা (রঃ) হযতর উমার (রাঃ) এর কন্যা ছিলেন । রাসূল কারীম (সঃ) এর ওফাতের পর হযরত উমার (রাঃ) ই সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রাঃ) এর নিকট বায়াত হন ।

খেলাফত লাভ ও শাসনকার্য

হযরত আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফাতকালে হযরত উমার (রাঃ) ই ছিলেন তাহার প্রধান উপদেষ্টা । মৃত্যুর পূর্বে তিনি উমার (রাঃ) কেই তাঁহার স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেন, সাহাবীগণও সর্ব-সম্মতভাবে উমার (রাঃ) কে তাহাদের খলীফারুপে গ্রহণ করেন এবং এইরূপে নেতা নির্বাচনের আরবীয় প্রথানুসারে জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতেই উমার (রাঃ) তাঁহার খিলাফাত শুরু করেন । ঘরে বাহিরে উমার (রাঃ) যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হইলেন পূর্ব হইতেই তিনি ইহার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন । মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি করিবার জন্য যুদ্ধ করা তাঁহার অভিপ্রেত ছিল না । নৌ-যুদ্ধ তাঁহার দৃষ্টিতে অধিকতর অবাঞ্ছিত, কিন্তু মুসলিম শক্তিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করিবার জন্য বদ্ধপরিকর বিরুদ্ধ শক্তিগুলির সহিত মুকাবিলায় তিনিই ছিলেন অধিনায়ক । যে সকল সেনাপতি মুসলিমদের প্রয়াসকে সাফল্যমণ্ডিত করিয়াছিলেন তিনি ছিলেন তাহাদের সকলের নিয়ন্তা । এইক্ষেত্রে তাঁহার কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত । ইসলামের স্বার্থে খালিদ (রাঃ) এর ন্যায় একজন সুদক্ষ সেনাপতিকেও তিনি পদচ্যুত করিয়াছিলেন এবং খালিদ (রাঃ)ও এই পদচ্যুতি অবনত মস্তকে মানিয়া লইয়াছিলেন । ইহা তাঁহার বলিষ্ঠ কৃতিত্বেরই পরিচায়ক । এই ঘটনা হইতে রাসুল (সঃ) এর সাহাবী (রাঃ) গনের চরিত্র বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় মিলে । ‘আম্‌র ইবনুল আস (রাঃ) এর মিসর বিজয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দান করিয়া তিনি খুবই দূর-দৃষ্টির পরিচয় দেন । তিনি রাসূল কারীম (সাঃ) এর বিশিষ্ট সাহাবীদিগকে সম্ভ্রমবশত সাধারণ সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ করিতেন না । কিন্তু প্রয়োজন হইলে গুরুত্বপূর্ন পদে তাহাদিগকে নিয়োগ করিতে দ্বিধাবোধ করিতেন না । এইরূপে ইরাক ও সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসাবে তিনি কয়েকজনকে নিযুক্ত করেন ।
হযরত উমার (রাঃ) এর সময়েই ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি স্থাপিত হয় । এই সময়েই অনেকগুলি ইসলামী বিধি-ব্যবস্থা বাস্তব রূপ লাভ করে বলিয়া কথিত হয় । এইগুলির পূর্ন রুপায়ন ঐতিহাসিক বিকাশ ধারা অনুসারে ক্রমে ক্রমে সাধিত হইলেও ইহাদের সূচনা হযরত উমার (রঃ) এর সময়েই হইয়াছিল । যখনই কোন প্রশ্ন বা সমস্যার উদ্ভব হইত, তিনি সাহাবী (রাঃ) গনকে একত্র করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন সেই ব্যাপারে হযরত (সঃ) এর কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত আছে কিনা তাহাদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেন । কুরআন ও সুন্নাহ্‌ই ছিল তাঁহার সংবিধান এবং বিশিষ্ট সাহাবী [যথা আলী, আব্দুর রাহমান ইবন আওফ (রাঃ) প্রমুখ] গণ ছিলেন তাঁহার পরামর্শ সভার সদস্য । দীনতম নাগরিকও তাঁহার কর্মের সমালোচনা করিতে শুধু সাহসীই নহে বরং উৎসাহিতও হইতেন- ইহার বহু নজির পাওয়া যায় । তাঁহার জীবন যাপনের মান সাধারণ নাগরিকের অনুরূপ ছিল । এই বিষয়ে হযরত উমার (রাঃ) এর দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল ।
জিম্মি (মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিক) গণের অধিকার সংরক্ষণ, সরকারি আয় জনগণের মধ্যে বণ্টনের জন্য দীওয়ান ব্যবস্থার প্রবর্তন, সামরিক কেন্দ্র (যথাঃ বসরা, কুফা)- সমূহ প্রতিষ্ঠা (এই সকল কেন্দ্র হইতেই উত্তরকালে কয়েকটি বৃহৎ নগরীর সৃষ্টি হয়) । এতদ্বব্যতিত ধর্মীয়, পৌর এবং দণ্ডবিধি সঙ্ক্রান্ত বিশেষ বিধিও তিনি প্রবর্তন করেন । যথাঃ তারাবীহের সালাত জামা’আতে সম্পন্ন করা, হিজরি সনের প্রবর্তন, মদ্যপানের শাস্তি ইত্যাদি ।

শাহাদত:

উমার (রাঃ) এর অন্তরে আল্লাহ্‌র ভয় ও ভক্তির মধ্যে দৃশ্যত ভয়ই ছিল প্রবলতর । তিনি যে সম্মান অর্জন করেন তাহা তাঁহার চরিত্রগুণের কারনে, শারীরিক শক্তির জন্য নহে । যদি আবু উবায়দা (রাঃ) জীবিত থাকিতেন তবে তাহাকেই তাঁহার স্থলাভিষিক্তরুপে মনোনীত করিতেন, তাঁহার এইরূপ ইচ্ছা প্রকাশের বিবরন পাওয়া যায় । হযরত (সঃ) এর সত্যিকারের সাহাবী এবং কুরআন ও সুন্নাহ্‌র পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসারী খলীফারুপে মর্যাদার উচ্চ শিখরে সমাসীন থাকাকালে ২৬ জুল হিজ্জাঃ ২৩/৩ নভেম্বর, ৬৪৪ সালে তিনি মুগীরাঃ ইবন শু’বা’র খ্রিষ্টান ক্রীতদাস আবু লু’লু’র ছুরিকাঘাতে শাহাদাত প্রাপ্ত হন । ইতিহাসে কথিত হইয়াছে যে, উমার (রাঃ) এর নিকট আবু লু’লু’ তাঁহার মনিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে । উমার (রাঃ) এর বিচারে অসন্তুষ্ট হইয়া সে নিহায়েত ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে অতর্কিতভাবে তাহাকে হত্যা করে । মৃত্যুর পূর্বে উমার (রাঃ) ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর নামোল্লেখ (‘উছমান এবং আলী (রা:) ও তাহাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ) করিয়া পরামর্শক্রমে তাহাদের মধ্যে একজনকে খলীফা মনোনীত করার উপদেশ দিয়া যান । ইহার ফলে হযরত উছমান (রাঃ) খলীফা মনোনীত হন ।
আল মুহিব্বুল তাবারীর আর-রিয়াদুন-নাদিরা ফী মানাকিবিল আশারাঃ, কায়রো ১৩২৭, পুস্তকে তাঁহার গুণাবলীর আলোচনা আছে । শী’আ সম্প্রদায় তাহাকে ভাল চক্ষে দেখে নাই; কারন তাঁহারা মনে করে, যাহাদের কারণে আলী (রাঃ) রাসূল (সঃ) এর খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হইতে পারেন নাই, উমার (রাঃ) তাহাদের অন্যতম । সূফীগণ হযরত উমার (রাঃ) এর অনাড়ম্বর জীবন যাপন পদ্ধতির প্রশংসা করিয়াছেন ।